→ সিন্ধু সভ্যতা মূলত ছিল নগরকেন্দ্রিক বা নাগরিক সভ্যতা যা হরপ্পা মহেঞ্জোদরোয় নগরের ধ্বংসাবশেষে পরিলক্ষিত হয়। এই নগরগুলির গঠনরীতি দেখে বোঝা যায় যে নগরবিন্যাসের মান তখন কত উন্নত ছিল।
নগরের উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে সমান্তরালভাবে কয়েকটি রাস্তা চলে গিয়েছে। এই রাস্তাগুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য গলি। গলিগুলির দুপাশে নাগরিকদের ঘরবাড়ি ছিল এই বাড়িগুলি পোড়া ইটের তৈরি এবং অনেক বাড়ি দোতলা। প্রত্যেক বাড়িতে স্নানাগার, কুয়ো ও নর্দমার ব্যবস্থা ছিল। বাড়ির নোংরা জল নর্দমা দিয়ে এসে রাস্তার ঢাকা দেওয়া বাঁধানো নর্দমায় পড়ত।
শহরের উঃ পূর্ব কোণে সারিবদ্ধভাবে ছোট ছোট খুপরি জাতীয় কিছু ঘর ছিল। মনে হয় এগুলি দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের ব্যবহার স্থান ছিল। মহেঞ্জোদরোতে সর্বসাধারণের ব্যবহার উপযোগী একটি বিরাট বাঁধানো স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে। তার আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৮০ ফুট ও প্রস্থে ১০৮ ফুট। হরপ্পার কেন্দ্রীয় শস্যগারটির আয়তন ১৬৯×১৩৫ ফুট। হরপ্পা মহেঞ্জোদরো উভয় শহরেই একদিকে ছিল ধনীর প্রাসাদ ও অন্যদিকে নিম্নবিত্তের গৃহ। ডঃ কোশাম্বীর মতে এখানকার নগর পরিকল্পনায় শ্রেণি বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। এ.এল. ব্যাসাম-এর মতে শ্রমিক বা দাস শ্রেণির জন্য দুটি কক্ষ যুক্ত ইটনির্মিত বাড়ি থাকত। সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা সিন্ধু সভ্যতার নাগরিক জীবনের প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির ইঙ্গিত বহন করে।
পরিকল্পিত হরপ্পা নগরী সংস্কৃতির একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। দুইটি প্রধান নগরী মোহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা। মাটিন হুইলার বলেছেন মোহেনজোদারো যখন পরিকল্পিত হয়েছিল নগর পরিকল্পনা তখন শুধু মাত্র পরীক্ষার পর্যায়ে ছিল না-একটি উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল।এই নগর দুটিতে প্রধানত দুইটি অংশ ছিল। একটি অংশ অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে যেখানে দুর্গ ছিল। আর বাকি অংশ ছিল নিচু এলাকা। মনে করা হয় এখানে নিচু পদের লোকেরা বাস করত। দুইটি অংশের মধ্যে যোগাযোগের রাস্তাগুলি খুব চওড়া ছিল না।
রাজস্থানের কালিবঙ্গান এর দুর্গকে ঘিরে একটি বড় ইটের দেওয়াল ছিল। মোহেনজোদারের নগর দুর্গের কাছে বড় একটি স্নানাগার পাওয়া গেছে। এর কেন্দ্র স্থলে ৩৯ ফুট লম্বা, ২৩ ফুট চওড়া ও ৮ ফুট গভীর একটি জলাশয় ছিল এবং এই জলাশয়ে জল প্রবেশের ও জল নিষ্কাশনের সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। জলাশয়টিকে ঘিরে গ্যালারি ছিল। বিস্ময়ের বিষয় এই যে পাঁচ হাজার বছর পরেও স্নানাগারটি আজও অক্ষত আছে। দুইটি নগরের পরিকল্পনা প্রায় একই রকমের ছিল। প্রতিটির ক্ষেত্রেই নগর দুর্গের নিচে ছিল আসল শহর। দুই নগরেরই আয়তন ছিল প্রায় ১ বর্গ মাইল এখানকার রাস্তাগুলি ছিল প্রশস্ত এবং সোজা।
প্রতিটি অঞ্চলে অনেক অপরিসর রাস্তা ছিল। কাঁচা ইট পরে পোড়া ইটের সব বাড়ি তৈরি হয়েছিল। তবে কোন পাথরের বাড়ি ছিল না। ইটগুলি বেশ বড় ছিল। তবে সর্বত্র একই মাপের ইট ব্যবহার হত। হয়ত বন্যার হাত থেকে বাঁচার জন্যই পোড়া মাটির ইট তৈরি হত ব্যাপক ভাবে। এই সংস্কৃতি শ্ৰেণীবৈষম্য এড়াতে পারে নাই তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন আয়তনের বাড়িগুলি থেকে। একতলা, দোতলা বাড়ী যেমন ছিল তেমনি ছোট ও মাঝারি ধরণের বাড়ির চিহ্ন ও অনেক পাওয়া গেছে। বাড়িগুলোর আয়তনের তারতম্য থাকলেও পরিকল্পনা ছিল প্রায় একই রকমের। প্রতিটি বাড়িতে দরজা, জানালা সিঁড়ি স্নানঘর এবং একটি চারকোনার চত্বর ছিল। সরু গলি দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে হত। রাস্তার উপর কোন জানালা ছিল না। প্রতিটি বাড়িতে ২টির বেশি কুয়ো ছিল। বাড়ীর জল ও আবর্জনা নিস্কাশনের জন্য উন্নত পয়ঃপ্রণালীর ব্যবহার ছিল। হয়ত পয়ঃপ্রণালীর গঠন ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোন পৌর প্রতিষ্ঠান ছিল। বেশ কয়েকটি বাড়ীর ধ্বংশাবশেষে উন্নত মানের শৌচাগারের ব্যবহার দেখা গেছে। সাধারণ ভাবে বলা যায় প্রাচীন প্রাচ্যে এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
সিন্ধু উপত্যকার নগর দুইটির সঙ্গে তুলনায় কাথিয়াবাড়ে সমুদ্রতীরের বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বন্দর লোথাল-এর পরিকল্পনা একটু অন্য রকম ছিল। এখানে সমগ্র শহরটি ছিল প্রাচীর বেষ্টিত। শহরের পূর্ব দিকে জাহাজ মেরামতের স্থান ছিল। এই সভ্যতায় মন্দির বা উপাসনালয়ের অস্তিত্ব ছিল কিনা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। অনেক বড় বড় বাড়িগুলিকে মন্দির রূপে গণ্য করা হয়। কিন্তু এই বাড়িগুলির মধ্যে কোন মূর্তি পাওয়া যায় নাই। তবে এই সভ্যতায় পোড়া মাটির শিল্পকার্য এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। প্রসঙ্গত স্মরণীয় এই সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও বেশি ভাগ মানুষই কৃষিকার্যের সাথে যুক্ত ছিল। পরিশেষে বলা যায় হরপ্পা সংস্কৃতির লোকজন খুব শিল্পরুচিসম্পন্ন ছিল—একথা বলা যায় না। শিল্পের জন্য শিল্প-এই নীতিতে তারা বিশ্বাসী ছিল না। তাদের নগর পরিকল্পনা এবং গৃহ নির্মাণের মূল লক্ষ্য ছিল প্রয়োজন মেটানো সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য নহে। তাদের বাড়িঘরে কোন অলঙ্করণের চিহ্ন পাওয়া যায় না।
No comments:
Post a Comment