Sunday, December 19, 2021

হরপ্পা সভ্যতা পতনের কারণ নির্ণয় করো।


উত্তর : আনুমানিক ৩০০০ খ্রীঃ পূঃ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার অভ্যুদয় হয়েছিল। সিন্ধু নদী অধ্যুষিত এলাকায় এই সভ্যতা বিকাশ হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে মাটির নিচে স্থান পায়। এই সুপ্রাচীন সভ্যতা কেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো তার কারণগুলি অনুমান করা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বৈদেশিক আক্রমণের ফলে এই সংস্কৃতির অবসান হয়েছিল। কিন্তু কেবলমাত্র বিদেশী আক্রমণের ফলে একাজ সম্ভব নয়। ইহা শুধুমাত্র পতনকে ত্বরান্বিত বা সম্পন্ন করতে পারে। তাই এই সভ্যতার অবক্ষয়ের অন্যান্য কারণগুলিও অনুসন্ধান করা যেতে পারে।

১) জলবায়ুর পরিবর্তন -  খ্রীঃ পূঃ ৩০০০ অব্দে সিন্ধু নদী উপত্যকা অঞ্চলে যথেষ্ট বৃষ্টিপাত হত। জলবায়ু ছিল সমভাবাপন্ন। কিন্তু পরবর্তীকালে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমান কমে যায়। এর কারণ সম্পর্কে মার্টিনার হুইলার বলেন যে সিন্ধু নগরগুলোতে গৃহ নির্মাণের জন্য প্রচুর পোড়ামাটি ও ইটের দরকার হয়। ইট পোড়াবার জন্য জ্বালানির প্রয়োজনে নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন শুরু হয়। যার ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায়। এর ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।

২) মরুভূমির বিস্তার -  বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় আবহাওয়া শুষ্ক হয় এবং মটি লবণাক্ত ঊষর হয়ে পড়ে। এইভাবে সিন্ধু অঞ্চলে ক্রমশঃ মরুভূমিতে পরিণত হয় এবং এখানকার কৃষি উৎপাদন কমে যায়। ফলে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

৩) মানুষের অযত্ন ও সংরক্ষণের অভাব- মানুষের অযত্ন এই অঞ্চলের সভ্যতার ধ্বংসের জন্য বিশেষভাবে দায়ী। প্রাচীনকালের ভারতীয় পশ্চিম প্রান্তে সভ্যতার যে ঊষালগ্ন সৃষ্টি হয়েছিল তা সংরক্ষণ করার কোন চেষ্টা হয়নি। এমন কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়নি যাতে এই সভ্যতা কালের অমোঘ শাসন থেকে রক্ষা পেতে পারে।

৪) ভূমিকম্পঃ মহেঞ্ঝোদাড়ো এলাকায় জলবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার পর অনেকে বলেছেন যে সুদূর অতীতে এই নগরের কাছে ভয়াবহ ভূমিকম্পের এক উৎসস্থল ছিল, ফলে এই নগরী ধ্বংস হয়েছিল।

৫) বন্যা : সিন্ধু নদের বন্যাও এই সভ্যতাকে ধ্বংস করে থাকতে পারে। এই বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে যে সমস্ত বাঁধ নির্মাণ করা প্রয়োজন ছিল তার ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই সিন্ধু নদীর বন্যা এই সভ্যতাকে ধ্বংস করে থাকতে পারে। সেইজন্য এম.আর.সাহানী বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন, “প্লাবনই সিন্ধু সভ্যতাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।”

৬) সিন্ধু নদীর গতিপথ পরিবর্তনঃ অনেকের মতে সিন্ধু নদীর গতিপথ পরিবর্তনই এই নগরীর ধ্বংস হবার প্রধান কারণ। এই পরিবর্তন দুই দিক থেকে হরপ্পা ও মহেঞ্ঝোদাড়োকে আঘাত করেছিল।

প্রথমতঃ বন্দর হিসাবে এর কোন গুরুত্ব ছিল না।

দ্বিতীয়তঃ জলবায়ু ও শুষ্কতা বৃদ্ধির ফলে এখানকার কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নিচে নেমে গিয়েছিল। যার ফলে বিদেশীরা সহজে এই নগর অধিকার করতে পেরেছিল।

৭) বিদেশী শত্রুর আক্রমণঃ খ্রীঃ পূঃ ১৫০০ অব্দে এই সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই সময় আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। খুব সম্ভবতঃ আর্যরাই হরপ্পা সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিল। এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে যেসব কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে তার মাথায় এবং শরীরে তীব্র আঘাতের চিহ্ন আছে। এই ধ্বংসাবশেষ থেকে বড় বড় লোহার অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। এই সকল নিদর্শন সমূহ অনুযায়ী অনুভূত হয় যে হরপ্পা ধ্বংসকারী হিসাবে আর্যদের অভিহিত করা যায়। তাছাড়া ঋগ্বেদে পুরন্দর ইন্দ্র যে ধরণের দূর্গ নষ্ট করেছেন বলা হয়েছে অনেকটা সেই ধরণের দুর্গ হরপ্পায় পাওয়া গিয়েছে। অধ্যাপক পিগট এই তথ্যগুলির উপর নির্ভর করে আর্যরা কিভাবে হরপ্পা ধ্বংস করেছিল তার বর্ণনা করে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। মার্টিনার হুইলারও পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে হরপ্পা ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত তথ্যগুলির সাহায্যে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, আর্য আক্রমণের ফলেইহরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটে। হুইলার মনে করেন যে, হরপ্পা দুর্গের সর্বোচ্চ স্তরে যে সমাধিক্ষেত্রটি পাওয়া যায় এবং সমাধি ক্ষেত্রে যেসব নরদেহের অবশিষ্ট পাওয়া গিয়েছে, সেই দেহগুলির অধিকারীরা ছিলেন আদি বৈদিক আর্য। তাই হুইলার বলেছেন, “ইতিহাসের দরবারে আর্যগণ সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতার ধ্বংসাকারী রূপে অভিযুক্ত।”

৮. আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-  হরপ্পার অন্তিম পর্বে এই সভ্যতার পতনের অন্যতম কারণ ছিল রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। মহেনজোদারোয় প্রাপ্ত স্তূপীকৃত কঙ্কাল এবং একটি কুয়োর ধারে সিঁড়ির উপর পাওয়া একটি নারী দেহের কঙ্কাল তাদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর স্মারক হয়ে আছে। অনেকের মাথায় খুলিতে ভারি অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন মৃত্যুর ভয়াবহতা ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই রক্তপাত কেন হয়েছিল কারা ঘটিয়েছিল এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো মতে গৃহযুদ্ধই এই রক্তপাতের কারণ। আবার কারো মতে বিদেশী আক্রমণকারীরা এই রক্তপাতের জন্য দায়ী।

No comments:

Post a Comment