বাক্যালাপ বা আলাপ-আলোচনা সম্পৰ্কীয়
ফ্রান্সিস বেকন
এমন কিছু লোক আছেন যারা বাক্যালাপের মধ্য দিয়ে নিজের বিচারবুদ্ধির বাহাদুরী দেখবার চেষ্টা করেন। তাঁরা সত্য নির্ণয়ের চেয়ে নিজের যুক্তির প্রাধ্যান্য বা শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কি বলা উচিত—এর চেয়ে তারা বেশি গুরুত্ব দেন বাস্তবিক পক্ষে কি বলা হয়েছে তারউপরে। কিছু লোক কথোপকথনে অতি সাধারণ বিষয়বস্তুগুলি উত্থাপন করে। ফলে তাদের কথোপকথন হয় বৈচিত্র্যবিহীন, একঘেয়ে এবং হাস্যকর। আলাপ আলোচনার সময় বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করা, বিষয় থেকে বিষয়াত্তরে যাওয়া দরকার। আলোচনার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের উত্থাপন, বিভিন্ন গল্পের অবতারণা, প্রশ্ন উত্থাপন ও তার উত্তর প্রদান করা, লঘুর সাথে সংমিশ্রণ থাকা চাই; একটি মাত্র বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করলে সেটি একঘেয়ে হয়ে ওঠে। কিন্তু কতকগুলি বিষয় নিয়ে রসিকতা করা উচিত নয়, যথা—ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি, মহাপুরুষ, কোন বিশেষ ব্যক্তির পেশা, এবং যে সমস্ত বিষয়গুলি সহানুভূতির উদ্রেক করে। কিন্তু এমন কিছু লোক আছেন যাঁরা অপরকে খোঁচা দিয়ে কথা না বলতে পারলে নিজের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেওয়া হল না বলে মনে করেন। এই জাতীয় মনোভাব সংযত করা প্রয়োজন।— হে বালক, ডাঁঙশ্ মেরো না, লাগাম শক্ত করে টেনে ধর।
মানুষের উচিত নোন্তা এবং তিক্ততার মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করা। যে অপর লোক সম্বন্ধে ঠাট্টা তামাসা বক্রোক্তি করে, অন্য ব্যক্তির সম্পর্কে তার সাবধান থাকা উচিত। যিনি অন্য ব্যক্তিকে বেশী প্রশ্ন করেন তিনি বেশী বিষয়ে জানতে পারেন, কিন্তু তার প্রশ্নাবলী যেন পীড়াদায়ক না হয় কারণ এ জাতীয় প্রশ্ন পরীক্ষকের পক্ষে মানান সই হবে। একই ব্যক্তির পক্ষে দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া উচিত নয়, অন্য ব্যক্তিকেও কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। একজন যদি খুব বেশীক্ষণ কথা বলে তাকে সরিয়ে নিতে হবে এবং তার জায়গায় অন্যকে নিয়ে আসতে হবে যেমন গ্যালিয়ার্ড নৃত্যে বাদকগণ যারা দীর্ঘক্ষণ নৃত্য করে তাদেরকে সরিয়ে দেয়। এছাড়া জ্ঞানভাণ্ডারের সবটুকু একসাথে প্রকাশ করা উচিত নয়, খানিকটা জ্ঞান চেপে রাখা দরকার, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য লোকেরা তোমাকে বিরাট পণ্ডিত মনে করবে অর্থাৎ তুমি যা জান না সেটিকেও মনে করবে তুমি জান। বাক্যালাপের সময় নিজের প্রশংসা করা উচিত নয়; একমাত্র সেই গুণটি যেটি তোমার মধ্যে আছে সেটি অন্যের মধ্যে যদি দেখ তাহলে তার সেই গুণটির প্রশংসা করবে। কথাবার্তায় অন্যকে আক্রমণ করবে না; আলোচনার পরিধি হবে ব্যাপক, ফাঁকা মাঠের মত। সেটি যেন ব্যক্তি বিশেষের দিকে চালিত না হয়। অপর ব্যক্তি সম্পর্কে কটু মন্তব্য করলে সেটি একটি উত্তম নৈশভোজকে মাটি করে ফেলতে পারে। বাক্পটু হওয়ার চেয়ে সাবধানী বা বিচক্ষণ হওয়া ভাল। বিরামবিহীন সুদীর্ঘ ভাষণ অলসতার লক্ষণ; কথোপকথনের মধ্যে প্রশ্ন করা ও তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন, তা না হলে সেটি একঘেয়ে হয়ে যাবে। গ্রে হাউণ্ড বহুদূর একটানা দৌড়তে পারে, খরগোস অত দৌড়াতে পারে না বটে, কিন্তু খুব দ্রুত বেঁকতে বা মোড় নিতে পারে। তেমনি, সমালোচনার স্থান নেই, বুদ্ধির চাতুর্য্য নেই– এরূপ বক্তা হলেন গ্রে হাউণ্ডের মত। অন্য আর প্রকারের বক্তার মধ্যে বাক্চাতুর্য থাকে বটে কিন্তু তার বক্তৃতার মধ্যে গভীরতা থাকে না। মূল আলোচ্য বিষয়ে আসার আগে বহু আনুষঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করা ক্লান্তিকর, আদৌ কোনো আনুষঙ্গিক বিষয় উল্লেখ না করা নীরস ব্যাপার।
No comments:
Post a Comment